Header Ads

Header ADS

Constructivism: আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বয়ান, আইডিয়া ও পরিচয়ের গুরুত্ব

 


Constructivism 

Constructivism বা কাঠামোবাদ একটি সামাজিক তত্ত্ব, যার মতে সামাজিক বাস্তবতা (social reality) গড়ে ওঠে মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগ (interactions) ও ব্যাখ্যার (interpretations) মাধ্যমে। মানুষ একে অপরের কাজ ও আচরণ ব্যাখ্যা করে এবং সেই ব্যাখ্যার ভিত্তিতে সামাজিক বাস্তবতাকে নির্দিষ্ট করে। এই তত্ত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এটি আমাদের দেখায়, আমরা যেসব বিষয়কে বাস্তব বা নিরপেক্ষ সত্তা/ সত্য  বলে মনে করি, সেগুলো আসলে সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মানুষের ব্যাখ্যা, পারস্পরিক যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। 

Constructivism কোনো পূর্বনির্ধারিত অনুমান (Hypothesis) ভিত্তিক তত্ত্ব নয়, বরং এটি একটি বিকল্প বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি, যা ভাষ্য বা বয়ান বা ব্যাখ্যাকে বিশ্লেষণ (discourse analysis)-এর মাধ্যমে সামাজিক বাস্তবতা বা পরিস্থিতিকে গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করে। ১৯৬৬ সালে, Peter Berger ও Thomas Luckmann-এর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ The Social Construction of Reality প্রকাশের পর থেকে Constructivism তত্ত্বটি বেশ জনপ্রিয়তা পায় এবং সমাজবিজ্ঞান (sociology), নৃতত্ত্ব (anthropology), ও মানববিদ্যা (human sciences)-সহ বিভিন্ন শাখায় ব্যাপক প্রভাব ফেলতে শুরু করে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণে Constructivism 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বিশ্লেষণে Constructivism খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই তত্ত্বটি মূলত "Frankfurt School of Thought" (ফ্রাংকফুর্ট চিন্তাধারা) পরিবারের অন্যতম সদস্য হিসেবে বিবেচিত হয়। Constructivism আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে তিনটি প্রধান দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে: 

১. আন্তঃব্যক্তিকেন্দ্রিকতা (Intersubjectivity) – মানুষ কীভাবে পারস্পরিকভাবে বা সামাজিকভাবে বয়ান বা ভাষ্য বা পরিচিতি নির্মাণ করে? 

২. কর্মক (Agents) ও কাঠামোর (Structures) পারস্পরিক সম্পর্ক (Mutual interaction) কীভাবে একে অপরকে প্রভাবিত করে ও গড়ে তোলে?

৩. ব্যাখ্যার পুনঃব্যাখ্যা (Double Hermeneutics) – মানুষ কিভাবে অন্যের ব্যাখ্যাকে আবার নতুন ব্যাখ্যা করে এবং তার ভিত্তিতে নতুন বয়ান বা ভাষ্য বা আইডি্যা তৈরি হয়? 

যেখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বিশ্লেষণে এই শাস্ত্রের প্রচলিত তত্ত্বগুলো, যেমনঃ বাস্তববাদ (realism)- রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ক্ষমতা-স্বার্থের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে, সেখানে, Constructivism এই শাস্ত্র অনুধাবনে সমাজতাত্ত্বিক (sociological) দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। এই তত্ত্ব দাবী করে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আসলে সামাজিক সম্পর্ক, পরিচয়, বয়ান ও মূল্যবোধের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়, এবং ফলে এই শাস্ত্রকে গভী্রভাবে অনুধাবনে বা ব্যাখ্যায় কেবল বস্তুগত (material) বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং আইডিয়া নির্ভর সামাজিক কাঠামোর দিকেও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।  

Constructivism তত্ত্বের তাত্ত্বিকগণ মনে করেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পাঠ্যক্রম ও গবেষণায় সাধারণত কর্মক (agents), যেমন: রাষ্ট্র (state), ব্যবস্থা বা সিস্টেম (system), এবং ব্যক্তি (individual)- প্রভৃতি্র রাজনৈতিক জীবন ও আচরণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এই রাজনৈতিক জীবনে যে সামাজিক উপাদানসমূহ (social factors) কার্যকর ভূমিকা পালন করে, তা খুব কমই গুরুত্ব পায়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বিশ্ব রাজনীতি গড়ে উঠেছে সামাজিক সম্পর্ক (social relations) এবং পারস্পরিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে। কনস্ট্রাকটিভিস্টদের মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিও মানুষের অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ডের মতোই, যেখানে অর্থ, ধারণা, পরিচয়, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।তারা বলেন, মানব কার্যকলাপ যেমন সমাজে পরিবর্তন আনে, তেমনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির কাঠামো ও আচরণেও পরিবর্তন ঘটায়। অর্থাৎ, রাজনীতি শুধু শক্তি ও স্বার্থের দ্বারা নয়; এটি মানুষের চিন্তা, ভাষা ও পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়েও গঠিত ও রূপান্তরিত হয়। 

প্রায় পাঁচ দশক আগে দর্শন, সমাজবিজ্ঞান এবং নৃতত্ত্বের মত পাঠ্যক্রমে Constructivism Theory-এর আগমন ঘটে। তত্ত্বটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (IR) শাস্ত্রে প্রবেশ করে ১৯৮০-এর শেষ থেকে ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে।

Constructivism তত্ত্বের আগমনের পিছনে প্রধানত দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ভূমিকা রয়েছে। যথাঃ 

১. স্নায়ুযুদ্ধের পতন ব্যাখ্যা করতে প্রচলিত তত্ত্বগুলোর ব্যর্থতা:

স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। কিন্তু, Realism ও Liberalism-এর মতো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রধান প্রধান তত্ত্বগুলো এই পতনের পূর্বাভাস দিতে পারেনি, এমনকি যথাযথভাবে ব্যাখ্যাও করতে পারেনি। ফলে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাস্ত্রে একধরনের তাত্ত্বিক সংকট দেখা দেয়, যেখানে Constructivism Theory গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

২. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বের “তৃতীয় বিতর্ক” (Third Debate):

১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বে একটি নতুন বিতর্কের সূচনা হয়, যাকে বলা হয় Third Debate। এটি মূলত epistemology (জ্ঞানের উৎস ও প্রকৃতি) বিষয়ক বিতর্ক, যেখানে প্রচলিত তত্ত্বের গবেষণা পদ্ধতি (methodology) ও বিশ্লেষণী কাঠামো (analytical framework)-কে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। এই পর্যায়ে সমাজবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক চর্চায় এমন ধারণা জোরালো হতে থাকে যে, রাজনীতি কেবল বস্তুগত বাস্তবতায় (material reality) গঠিত নয়, বরং এটি সামাজিকভাবে নির্মিত (socially constructed) এক ক্ষেত্র। 

এই দুই পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, ১৯৯০-এর দশকে Constructivism ধীরে ধীরে একটি ‘মধ্যমপন্থী’ তত্ত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এটি বস্তুবাদী (positivist/ materialist) ও ভাববাদী (idealist) তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে সমাজ কাঠামো, পরিচয়, ভাষা ও মূল্যবোধের আলোকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের প্রতি বেশী গুরুত্ব দেয়।

এই ধারার অন্যতম প্রভাবশালী চিন্তাবিদ Alexander Wendt- বলেন,

“Anarchy is what states make of it”

- নৈরাজ্য (Anarchy) তাহাই যেভাবে রাষ্ট্র তাহাকে উপস্থাপন করে। 

এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার নৈরাজ্য (Anarchy) কোনো প্রাকৃতিক বা অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা নয়। এটি হলো একধরনের সামাজিকভাবে নির্মিত বয়ান বা ভাষ্য যা রাষ্ট্রসমূহ নিজেরা নিজেদের স্বার্থের ভিত্তিতে প্রচার করে এবং প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। Wendt-এর মতে, রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পরিসরে যেভাবে চিন্তা করে, নিজের স্বার্থ যেভাবে সংজ্ঞায়িত করে, এবং একে অপরের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করে ইত্যাদি্র ভিত্তিতেই Anarchy একটি স্থায়ী অবস্থা হিসেবে গৃহীত হয়। অর্থাৎ, Anarchy কোনো চূড়ান্ত সত্য বা বাস্তবতা নয়, বরং এটি রাষ্ট্রসমূহের (বিশেষত বৃহৎ শক্তি্র) পারস্পরিক সম্পর্ক, আইডিয়া ও বয়ানের মাধ্যমে নির্মিত একটি সামাজিক বাস্তবতা। 

একারণে, একই Anarchy কাঠামোর মধ্যেও রাষ্ট্রের আচরণ ভিন্ন হতে পারে। যেমনঃ একই নৈরাজ্য কাঠামোভুক্ত (Anarchic structure) হওয়া স্বত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পরস্পরের প্রতি সহযোগিতামূলক আচরণ করে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মাঝে সম্পর্ক শত্রুভাবাপন্ন। আবার, নিউক্লি্যার অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলের সাথে আমেরিকার মিত্রতা রয়েছে, কিন্তু নিউক্লি্যার শক্তিধর না হওয়ার পরও ইরানের সাথে আমেরিকার শত্রুতা চলছে, এমনকি বর্তমানে ইসরায়েলের হয়ে ইরানকে আক্রমন করেছে আমেরিকা। ভারত ও ভুটানের মধ্যে সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হলেও, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে রয়েছে দ্বন্দ্বপূর্ণ ও অবিশ্বাসনির্ভর সম্পর্ক। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণে Constructivism-এর অন্যতম অবদান হলো, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বহুল চর্চিত ‘স্বার্থ (Interest)’ ধারণাকে বিশ্লেষণ করা, এবং বিভিন্ন তত্ত্বে এটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করা।Constructivism এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রভাবশালী প্রচলিত তত্ত্বগুলো, যেমন Realism বা Liberalism উভয়েই স্বীকার করে যে, রাষ্ট্র বা ব্যক্তি (agent) নির্দিষ্ট কিছু স্বার্থ (interests) নিয়ে কাজ করে এবং সেই স্বার্থ পূরণের লক্ষ্যেই তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তবে, উভয় ধরণের তত্ত্বের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে: যেখানে প্রচলিত তত্ত্বগুলো ধরে নেয় যে, স্বার্থ আগে থেকেই নির্ধারিত (pre-given), এবং এই স্বার্থ কোথা থেকে, কেন বা কীভাবে তৈরি হয়, তা আলোচনার প্রয়োজন নেই। প্রচলিত তত্ত্বগুলো ধরে নেয় যে স্বার্থ নির্দিষ্ট এবং অপরিবর্তনীয়, এবং রাজনীতি হলো সেই স্বার্থগুলো অর্জনের কৌশলগত প্রয়াস মাত্র। 

Constructivism এই জায়গাতেই ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে এবং প্রশ্ন তোলে: “মানুষ বা রাষ্ট্র যা চায়, তা চাইতে শেখে কীভাবে?” অর্থাৎ, এই তত্ত্ব দাবী করে যে, স্বার্থ হলো সামাজিকভাবে নির্মিত (socially constructed) একটি বিষয়, যা নির্দিষ্ট সংস্কৃতি, পরিচয়, বিশ্বাস ও পারিপার্শ্বিক প্রভাবের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। তাই, স্বার্থের উৎপত্তি ও নির্মাণ প্রক্রিয়া না বোঝা পর্যন্ত রাজনীতির প্রকৃত রূপ অনুধাবন করা সম্ভব নয়। Constructivist-দের মতে, যদি রাজনীতি সত্যিই স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে সেই স্বার্থগুলো কীভাবে, কোথায় এবং কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে, তা বিশ্লেষণ করাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের মৌলিক লক্ষ্য হওয়া উচিত। 

এই লেখায় আমরা Constructivism তত্ত্বকে দুইভাগে ব্যাক্ষা করবো। প্রথমত আমরা এই তত্ত্বের ক্রমবিকাশের ধারা নিয়ে জানবো। দ্বিতী্য় অংশে আমরা Constructivism তত্ত্বটি যে প্রধাণ তি্নটি ভিত্তি্র উপর দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো উদাহরণ সমেত আলোচনা করবো। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্কে Constructivism তত্ত্বের ক্রমবিকাশঃ 

১৯৮৯ সালে Nicholas Onuf তার প্রকাশিত বই World of Our Making-এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (IR) শাস্ত্রে Constructivism ধারণাটিকে পরিচিত করান। পরবর্তী দশকে তত্ত্বটি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং নতুন শতকের (বিংশ) শুরুর দিকে, বিশেষত Alexander Wendt-এর প্রভাবশালী গ্রন্থ Social Theory of International Politics (১৯৯৯) প্রকাশের পর এই তত্ত্বের স্বর্ণযুগ শুরু হয়। বর্তমানে Constructivism আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তাত্ত্বিক পরিসরে একটি প্রতিষ্ঠিত ও বিকল্প বিশ্লেষণ পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত। এই তত্ত্বের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক চর্চায় একটি গভীর তাত্ত্বিক রূপান্তর ঘটেছে, যা প্রচলিত বাস্তববাদী ও উদারতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করে। 

এই তত্ত্বের বিকাশ তিনটি ধাপে হয়েছে:

১. Epistemological বা জ্ঞানতাত্ত্বিক ধাপঃ এই ধাপে প্রশ্ন তোলা হয়- জ্ঞান কীভাবে তৈরি হয়? কে ঠিক করে কী সত্য, আর কী মিথ্যা?

২. Ontological বা সত্ত্বাতাত্ত্বিক ধাপঃ  এখানে প্রশ্ন করা হয়- আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কী? শক্তি, স্বার্থ, না কি আইডিয়া, পরিচয় ও মূল্যবোধ?

৩. Methodological বা পদ্ধতিগত ধাপঃ  এই ধাপে দেখা হয়- এই তত্ত্ব দিয়ে আমরা কীভাবে গবেষণা করব? কোন পদ্ধতিতে তথ্য বিশ্লেষণ করব?

Epistemological বা জ্ঞানতাত্ত্বিক ধাপঃ

১৯৮০-এর দশকের শুরুতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বে Neorealism বা নব্য-বাস্তববাদ প্রধান ধারায় পরিণত হয়। এই একক আধিপত্যের প্রতিক্রিয়ায় যে “তৃতীয় বিতর্ক” (Third Debate) শুরু হয়েছিলো, তা Constructivism তত্ত্বের বিকাশের পথকে প্রস্তুত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিলো। এই সময় ইউরোপীয় দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত কতিপয় ক্রিটিক্যাল ঘরনার তাত্ত্বিকগণ, প্রচলিত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষণাকে Positivist গবেষণা পদ্ধতি, অর্থাৎ, কেবল পরিমাপযোগ্য ও বস্তুগত বাস্তবতা নির্ভর বা বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে গবেষণা হতে হবে - এমন বয়ানকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন। তাঁরা যুক্তি দেন, ভাষা কেবল ভাব প্রকাশের বাহন নয়, বরং ভাষার রয়েছে এক বিশাল রূপান্তরযোগ্য শক্তি; ভাষা যেমন একদিকে ধারণা বা আইডিয়া বা বয়ান তৈরি করে, তেমনি অন্যদিকে সে ধারণা বা আইডি্যা বা বয়ানকে বাস্তবে রূপান্তর ঘটাতে চায়। এই প্রক্রি্যাকে বলা হয় Linguistic Turn। এর ফলে, প্রচলিত প্রাকৃতিক বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের পরিবর্তে নতুন এক ধরণের গবেষণা/ বিশ্লেষণ পদ্ধতি্র সূচনা হয় যাকে Post-positivist Epistemology বলা হয়। এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়: Reflexivity (নিজের অবস্থান ও পদ্ধতি নিয়ে ভাবনা), এবং বহু দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতির বৈচিত্র্য (plurality of viewpoints and methods)-কে। এই তৃতীয় বিতর্ক দুই দশকের বেশি সময় ধরে চললেও, শেষ পর্যন্ত এটি কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। উভয় পক্ষই (positivist ও post-positivist) নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকেছেন। তর্ক অনেক হয়েছে, কিন্তু সে তুলনায় অগ্রগতি ছিল সীমিত। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক চর্চায় যখন তাত্ত্বিকভাবে বড় ধরনের পরিবর্তন চলছিল, সেই প্রেক্ষাপটে Constructivism একটি "তৃতীয় পথ" (Third Way) হিসেবে আবির্ভূত হয়। এটি কিছু সময়ের জন্য হলেও দুই বিপরীতমুখী ধারার (Positivist ও Postpositivist) কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন তোলে এবং কিছু যৌথ সমাধানের পথ নির্দেশ করে। Constructivism তত্ত্ব Positivist গবেষকদের উদ্দেশ্যে বলে, তারা যেন তাদের প্রচলিত তত্ত্বে বস্তুগত উপাদানের (material variables) পাশাপাশি ভাবগত উপাদানগুলোর (ideational variables) ভূমিকাকেও স্বীকার করে। অর্থাৎ, কেবলমাত্র শক্তি, অর্থ বা সামরিক ক্ষমতা নয়, রাষ্ট্রের চিন্তা, পরিচয়, মূল্যবোধ ইত্যাদিও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে, Postpositivist চিন্তাবিদদের দৃষ্টিতে Constructivism-এর ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব বোঝায় যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বে সমালোচনামূলক (critical) ও বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর প্রয়োজনীয়তা দিনে দিনে বাড়ছে। 

তবে, বাস্তবতায় Constructivism-এর এই মধ্যবর্তী অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কারণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাস্ত্রে “ব্যাখ্যা (explaining) বনাম অনুধাবন (understanding)”—এই মৌলিক তাত্ত্বিক বিতর্ক এতটাই তীব্র ছিল যে, দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থানে অনড় রয়ে যায়। এই তৃতীয় বিতর্ক (Third Debate) আজও পুরোপুরি মিটে যায়নি।

এখনো দুই ধরনের Constructivist গবেষক দেখা যায়:

  • Scientific/Realist Constructivists ঃযারা Positivism মেনে চলতে প্রস্তুত এবং পরিমাপযোগ্য, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে গুরুত্ব দেয়।
  • Interpretive Constructivists ঃ যারা দর্শনের দিক থেকে Postpositivism-এর বেশি ঘনিষ্ঠ, এবং অর্থ, ভাষ্য ও সামাজিক ব্যাখ্যাকে অধিক গুরুত্ব দেয়।

Ontological (সত্ত্বাতাত্ত্বিক) বিশ্লেষণ ধাপ

Constructivism তত্ত্বের যাত্রা শুরু হয়েছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জ্ঞান কীভাবে গড়ে ওঠে—সেই প্রশ্ন ঘিরে, অর্থাৎ epistemological debate থেকে। এই পর্বে Constructivist গবেষকরা জানতে চেয়েছিলেন, আমরা যে ধারণা, অর্থ বা ব্যাখ্যা দিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বুঝি, সেই ধারণা, অর্থ বা ব্যাক্ষার জ্ঞান কীভাবে গড়ে ওঠে। তবে সময়ের পরিক্রমায় Constructivism ধীরে ধীরে epistemology থেকে সরে এসে মনোযোগ দেয় ontology বা সত্ত্বাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে।অর্থাৎ, বাস্তবতা (reality) নিজেই কী দিয়ে তৈরি হয়, সেই প্রশ্নে উত্তর খোঁজা তারা অধিক জরুরি মনে করেন। অনেক Constructivist গবেষক দাবী করেন যে, আমরা যে বিষয়কে "বাস্তব" বলে মনে করি, যেমন, আন্তর্জাতিক কাঠামো, রাষ্ট্রের স্বার্থ, শত্রু-মিত্রের সম্পর্ক ইত্যাদি এসব কেবল বস্তুগত (material) নয়, বরং ধারণা, বিশ্বাস, পরিচিতি ও সামাজিক অর্থের মাধ্যমে গঠিত। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃ্ত রূপ বুঝার ক্ষেত্রে, তাদের মতে, কেবল “জ্ঞান কীভাবে অর্জিত হয়  (epistemology)" তা খোঁজা যথেষ্ট নয়। বরং আমাদের আগে জানতে হবেঃ জ্ঞান ও বাস্তবতা গড়ে ওঠে কীভাবে, সেই সামাজিক প্রক্রিয়া কীরূপ। এই দৃষ্টিভঙ্গি Constructivism-কে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলধারায় একটি গ্রহণযোগ্য তাত্ত্বিক অবস্থান এনে দেয়। তবে, Constructivist-দের মধ্যে epistemology বনাম ontology বিতর্ক চলতে থাকে। কেউ কেউ ontology-কে epistemology থেকে আলাদা করে দেখেন, আবার অনেকে বলেন—এই দুইটি আসলে একই মুদ্রার দুই পিঠ। যেমন, গবেষক Stefano Guzzini বলেন:

"Constructivism is concerned with both the social construction of knowledge and the construction of social reality."

- অর্থাৎ, Constructivism তত্ত্ব একদিকে যেমন জানার পদ্ধতি নিয়ে কাজ করে, অন্যদিকে তেমনই বোঝার চেষ্টা করে, "যে বাস্তবতাকে (আমরা) জানার চেষ্টা করছি, সেটিই কীভাবে গড়ে উঠেছে"।

IR-এ Constructivism-এর দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ontological অবদানঃ 

১. বাস্তবতার সামাজিক নির্মাণ (Social Construction of Reality):

Constructivism তত্ত্ব অনুসারে, বাস্তবতা কেবল পদার্থ বা বস্তু দিয়ে গঠিত নয়; বরং ধারণা, অর্থ, ভাষ্য, বয়ান, বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। সমাজ ও রাজনীতিতে মানুষ যেসব ভাষ্য, বিশ্বাস ও বয়ান প্রতিষ্ঠা করে এবং প্রয়োজনে সেগুলোর প্রচার ও প্রসার ঘটায়, সেগুলো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বোঝার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, Neorealism তত্ত্ব বলে, সবকিছুই মূলত শক্তি ও নিরাপত্তার ইস্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে, Constructivist গবেষকরা এই নব্য-বাস্তববাদের উপস্থাপনাকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে, যেখানে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর গুরুত্ব প্রাধান্য পায়।  

২. কর্মক ও কাঠামোর পারস্পরিক সম্পর্ক (Mutual Constitution of Agents and Structures):

Constructivism মনে করে, রাষ্ট্র বা ব্যক্তি (agent) এবং আন্তর্জাতিক কাঠামো (structure) একে অপরকে প্রভাবিত করে এবং একযোগে বিকশিত হয়। অর্থাৎ, রাষ্ট্র শুধু আন্তর্জাতিক কাঠামো বা সিস্টেমের দ্বারা প্রভাবিত নয়, বরং রাষ্ট্রের নিজস্ব আচরণ ও কার্যক্রমও সেই কাঠামো বা সিস্টেমকে গড়ে তোলে এবং পরিবর্তন আনে।

এই দুটি মূল ধারণার ভিত্তিতে Constructivist গবেষকরা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণে নতুন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন—norms (নিয়ম), identity (পরিচয়), culture (সংস্কৃতি), communicative action (যোগাযোগভিত্তিক কর্ম), এবং community (সম্প্রদায়) ইত্যাদি যোগ করেন।

১৯৯০-এর দশক থেকে Constructivism দাবি করে আসছে যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি আদতে একটি “সামাজিকভাবে নির্মিত বাস্তবতা (Social Construction of Reality)”, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কেবল বস্তুগত বাস্তবতার ওপর নির্ভর করে না, বরং তা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বয়ান ও ভাষ্যের দ্বারা গঠিত। এই প্রেক্ষাপটে, Constructivism-এর সবচেয়ে আলোচিত উদাহরণ হলো ১৯৯৯ সালে প্রদত্ত Alexander Wendt-এর ‘Anarchy’ ধারণার নতুন ব্যাখ্যা, যেখানে তিনি বলেন:

“Anarchy is not fixed; it is shaped by culture, history, and interaction among states.”

অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার নৈরাজ্য (Anarchy) কোনো অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা নয়, এটি সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক ও আচরণের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে এবং পরিবর্তিত হয়।

পদ্ধতিগত (Methodological) ধাপ

যদিও Constructivism- Ontological (সত্তাতাত্ত্বিক) বিশ্লেষণ যুক্ত করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (IR)-এর তাত্ত্বিক আলোচনায় একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচন করে, তবুও কিছু সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়। বিশেষত, epistemology (জ্ঞানতত্ত্ব) ও ontology-র (সত্ত্বাতত্ত্ব) মধ্যকার বিতর্কের ফলে অনেক Constructivist তাত্ত্বিকেরা “আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তবতা সামাজিকভাবে নির্মিত” নামক তাঁদের মূল দাবিকে গবেষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে যথেষ্ট মনোযোগ দেননি। ফলে জ্ঞানের উৎস, গঠন ও যাচাইয়ের পদ্ধতি নিয়ে তাদের আলোচনায় একধরনের ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়।

২০০০ সালের পরবর্তী সময় থেকে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। Constructivist গবেষণা ধীরে ধীরে তাত্ত্বিক আলোচনার গণ্ডি পেরিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতানির্ভর বিশ্লেষণের দিকে এগোতে থাকে। এ সময় Constructivist-রা তাদের গবেষণা পদ্ধতিতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ যুক্ত করেন:

  1. পদ্ধতিগত রূপায়ণ (Methodology)
  2. কার্যকরীকরণ বা বাস্তবায়ন (Operationalization)
  3. অভিজ্ঞতামূলক বিশ্লেষণ (Empirical Analysis)

এই ধাপগুলো অনুসরণের করে Constructivist-রা গবেষণা পরিচালনা শুরু করেন, পরবর্তী্তে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা-সংক্রান্ত প্রশ্ন এই তাত্ত্বিকদের সামনে আসে, যেমন: 

  • বয়ান বা ভাষাগত বিশ্লেষণ (Discourse analysis) কীভাবে প্রয়োগযোগ্য, এবং তা কতটা কার্যকর?
  • পরিমাণগত বিশ্লেষণ (Quantitative methods) কি Constructivist যুক্তির সঙ্গে মানানসই?
  • Fieldwork-এ সংগৃহীত তথ্য Constructivist গবেষণার জন্য কীভাবে উপযোগী করা যায়?
  • বিভিন্ন ব্যাখ্যার মধ্যে তুলনামূলকভাবে কোনটি গ্রহণযোগ্য? এবং,
  • একটি কেস স্টাডির ফলাফল কি অন্য প্রেক্ষাপটে প্রযোজ্য? ইত্যাদি

এই প্রশ্নগুলোর গুরুত্ব ক্রমে বৃদ্ধি পায় এবং IR-এর গবেষণায় Constructivism-কে একটি পদ্ধতিগত পরিপক্ব গবেষণা পদ্ধতি হিসেবে এগিয়ে রাখে। Constructivist-দের এই methodological অগ্রযাত্রার বিপরীতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের (মূলধারার সাথে যুক্ত) অনেক গবেষক Constructivism-এর প্রতি প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেন। তারা Constructivist গবেষকদের প্রতি আহ্বান জানান, যাতে তারা কেবল তাত্ত্বিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তব রাজনৈতিক ইস্যুতে গবেষণা করেন—যাকে মূলধারার লেখকেরা “real research” হিসেবে বিবেচনা করেন। এর ফলে একটি তথ্যনির্ভর ও পদ্ধতিগতভাবে সুসংগঠিত গবেষণা ধারা গড়ে তোলার জন্য Constructivism-এর ওপর চাপ বৃ্দ্ধি পায়। 


Constructivism-এর তিন ভিত্তি:

১. Intersubjectivity (আন্তঃব্যক্তিকেন্দ্রিকতা):

Constructivism-এর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটি "intersubjective meaning" বা আন্তঃব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাষ্য বা বয়ানকে গুরুত্ব দেয়। এর মানে হলো, কোনো ধারণা বা ভাষ্য বা বয়ান কেবল ব্যক্তিগত (subjective) নয়, বরং তা অনেক মানুষের সম্মতি ও স্বীকৃতি্র মাধ্যমে গড়ে ওঠে।

উদাহরণ হিসেবে টাকার কথা বলা যায়। একটা কাগজে ছাপানো "১০০ টাকা" আসলে জৈবিক বা বস্তুগতভাবে মূল্যবান কিছু নয়। কিন্তু, সমাজ সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এটি ১০০ টাকার মূল্য বহন করে। তাই এটি দিয়ে জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয় করা যায়। ফলে টাকার ধারণাটি এসেছে intersubjective বয়ান ভাষ্য থেকে, যা ব্যক্তি বিশেষের মতামতের ওপর নির্ভর না করে, বরং সামাজিক সম্মতির ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে। একইভাবে, অর্থপূর্ণ সামাজিক রীতি ও কাঠামো, যেমনঃ নিয়ম (rules), মানদণ্ড (norms), পরিচয় (identity), সংস্কৃতি (culture), ভাষা (language) ইত্যাদি বিশ্ব রাজনীতিকে প্রভাবিত করে যা গড়ে উঠেছে আন্ত;ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বা সামাজিক স্বীকৃ্তি্র ভিত্তিতে। 

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এর প্রভাব কী?

Constructivist গবেষকেরা বলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে হুমকি (threat), জাতিগত পরিচয় (national identity), আন্তর্জাতিক নৈ্রাজ্যপূর্ণ সংস্কৃতি (international culture of anarchy), বা বিশ্বব্যবস্থার নিয়ম-কানুন ইত্যাদি সবই সামাজিকভাবে গঠিত এবং intersubjective। এমনকি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি (foreign policy)-ও নির্ধারিত হয় তাদের আত্মপরিচয় (identity) ও সাংস্কৃতিক বয়ানের ওপর।উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু জয়ী শক্তি হিসেবেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা ও আইনভিত্তিক ব্যবস্থার রূপকার হিসেবেও নিজেকে উপস্থাপন করে। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ গঠনের নেতৃত্ব নেয়, মানবাধিকার, মুক্তবাজার অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের মত সামাজিক ও আদর্শিক নীতিকে আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিষ্ঠা করে। 

এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব শুধু তার অর্থনৈতিক বা সামরিক শক্তির ফল নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই নেতৃত্ব কী অর্থ বহন করে, অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র শান্তি ও সহযোগিতার পক্ষে কাজ করছে; এটি বিশ্বে ন্যায়ের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায়; এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এইসব intersubjective ধারণা ও সামাজিক বা আন্তর্জাতিক সম্মতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্যকে বৈধতা দেয়। অর্থাৎ, John Ruggie-এর মতে, যুক্তরাষ্ট্রকে hegemon হিসেবে মেনে নেওয়া হয় তার প্রাতিষ্ঠানিক ও আদর্শিক ভূমিকার কারণে, কেবল তার শক্তি বা ক্ষমতার কারণে নয়।

এভাবে দেখলে বোঝা যায়, Constructivism তত্ত্বে intersubjectivity শুধুমাত্র একটি ভাষাতাত্ত্বিক ধারণা নয়, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি কাঠামোগত (structural) শক্তি, যা বিশ্ব রাজনীতির আচরণ ও বয়ান নির্মাণ করে।

2. কাঠামো ও কর্মকের পারস্পরিক গঠন (The Mutual Constitution of Structure and Agency)

কাঠামো ও কর্মকের পারস্পরিক গঠন বা সম্পর্ক একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে কর্মক (actors) এবং তাদের চারপাশের পরিবেশ (contexts) বা কাঠামো (structure) একসঙ্গে বেড়ে ওঠে এবং একে অন্যকে প্রভাবিত করে। এই ধারণাটি Anthony Giddens-এর Structuration Theory এবং Pierre Bourdieu-এর Theory of Practice থেকে এসেছে। এর মানে হলো, সামাজিক কাঠামো (structure) তখনই গড়ে ওঠে, যখন কর্মক সমাজে প্রচলিত নিয়ম-কানুন মেনে চলে, এবং সেই সামাজিক কাঠামোর নিয়মও আবার কর্মকের কর্মের ওপর নির্ভরশীল। যেমন ধরুন, একটি ফুটবল খেলা হচ্ছে। ফুটবল খেলার নিয়মগুলো (কাঠামো) খেলোয়াড়দের (কর্মকদের) আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে, খেলোয়াড়রা (কর্মকরা) সেই নিয়ম (কাঠামো) অনুসরণ করে খেলা চালি্যে যায়। এক্ষেত্রে (কাঠামো) নিয়ম না মানলে খেলা সম্ভব নয়, আবার খেলোয়াড় (কর্মক) না খেললে কাঠামোর নিয়মও কাজ করবে না। এইভাবে, খেলার নিয়ম (কাঠামো) আর খেলোয়াড় (কর্মক), দুটি একসঙ্গে একে অপরকে গড়ে তোলে। 

Wendt-এর ভাষায়, দুটি সামাজিক সত্যের মাধ্যমে এই ধারণাটি সহজে বোঝা যায়। যথাঃ 

১) মানুষ ও তাদের সংগঠনগুলো (যেমনঃ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি) একধরণের স্বতঃস্ফূর্ত কর্মক, অর্থাৎ তারা নিজেরা পরিকল্পনা করে কাজ করে এবং তাদের কাজের মাধ্যমে কাঠামো গঠিত ও প্রভাবিত হয়। উদাহরণ: সরকার একটি কর্মক। এই সরকার যখন একটি নতুন আইন প্রণয়ন করে, সেটা কাঠামোর নিয়ম-কানুন বদলে দিতে পারে। একইভাবে, বিশ্ব-রাজনী্তিতে রাষ্ট্রের আচারণকেও প্রভাবিত করতে পারে। যেমনঃ সম্প্রতি, ইরানে যখন আমেরিকা হামলা চালায়, তার প্রতিক্রি্যায় ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুশিয়ারি দেয়, যার আন্তর্জাতিক জ্বালানী ব্যবস্থা কেন্দ্রিক কাঠামোকে প্রভাবিত করে। 

২) সমাজ বা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা হলো সামাজিক বা রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কের সমষ্টি, যা মানুষের (সমাজের প্রেক্ষাপটে) সাথে এবং রাষ্ট্রের (আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে) সাথে আন্তর্জাতিক সিস্টেমের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া তৈরি করে। উদাহরণ: বিভিন্ন দেশের সরকার একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কাঠামো তৈরি করে। 

এই দুটো সত্য একত্রে নির্দেশ করে যে, কর্মক এবং কাঠামো তাত্ত্বিকভাবে পরস্পর নির্ভরশীল বা পারস্পরিক গঠিত (mutually implicating) সত্তা। অর্থাৎ, কাঠামো কর্মকের কার্যকলাপ থেকে জন্ম নেয় এবং কর্মকও কাঠামো দ্বারা গঠিত বা প্রভাবিত; কোনো একটিকে অন্যটির চেয়ে পূর্ণরূপে হ্রাস করা সম্ভব নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি একটি প্রক্রিয়াগত অস্তিত্বতাত্ত্বিক (processual ontology) জ্ঞানের কথা বলে, যেখানে কর্মক এবং কাঠামোকে স্থির হিসেবে না দেখে, বরং ক্রমাগত পরিবর্তনশীল একটি সম্পর্ক এবং কর্মকাণ্ডের ফলাফল হিসেবে দেখা যায়। এই কাঠামোয় তখনই স্থিতিশীলতা বা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, যখন কর্মক তা বজায় রাখতে চায় বা চ্যালেঞ্জ করে। 

বিশ্ব রাজনীতি অধ্যয়নে কাঠামো ও কর্মকের পারস্পরিক সম্পর্ক ও গঠনের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য John Searle  উল্লেখ করেন যে, কনস্ট্রাক্টিভিজম তত্ত্বের কাঠামো ও কর্মকের সম্পর্ক ও গঠন অনেকটা দাবার খেলোয়াড় ও তার নিয়্মের মত। অর্থাৎ, দাবার নিয়ম কেবল খেলোয়াড়দের চাল নিয়ন্ত্রণ করে না; বরং সেই নিয়মের কারণেই দাবা খেলা সম্ভব। নিয়ম না থাকলে দাবা খেলা যায় না, আবার নিয়ম প্রয়োগ ছাড়াও দাবাকে কোনো কাঠামো বলা যায় না।একইভাবে, সার্বভৌমত্বের (sovereignty) নীতিও বর্তমান আন্তর্জাতিক সমাজের গঠন সম্ভব করেছে। 

এই পারস্পরিক গঠনের তাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনায়, পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হলো পদ্ধতিগত: যদি আন্তঃব্যক্তিক কাঠামো এবং কর্মকের বয়ান বিশ্ব রাজনীতিকে গড়ে তোলে, তাহলে আমরা কিভাবে সেগুলোকে বিশ্লেষণ করবো?

ডাবল হার্মেনিউটিক্সঃ ব্যাক্ষার পুনঃব্যাক্ষা 

ডাবল হার্মেনিউটিক্স এমন এক ধরণের ব্যাখ্যামূলক পদ্ধতি, যা প্রচলিত ব্যাখ্যা বা বয়ানের পুনঃব্যাখ্যা বা পুনঃমূল্যায়নের করতে চায়। এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (IR)-এ কনস্ট্রাক্টিভিস্ট তত্ত্বের এক মৌলি্ক দার্শনিক লক্ষ্য। কারণ, বিশ্ব রাজনীতি এমন এক বাস্তবতা, যা এর কর্মকদের (প্রধানতঃ রাষ্ট্র) দ্বারা পূর্ব থেকেই বয়ান বা ব্যাক্ষা আকারে প্রতিষ্ঠিত। যেহেতু কর্মকের আচারণ তার ব্যবহৃত ভাষা বা বয়ানের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তাই সেই ব্যাখ্যা ও বয়ানকে কনস্ট্রাক্টিভিস্টরা তাদের গবেষণার মূল বিষয়বস্তু হিসেবে বি্বেচনা করে। 

মানুষ বা রাষ্ট্র নিজেরা বিভিন্ন বিষয়কে এক এক ভাবে দেখে বা বোঝে। যেমন, একটা দেশ মনে করে আরেকটা দেশ তার জন্য হুমকি। এখানে সেই দেশের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এরূপ ভাষ্য বা বয়ান ফুটে ওঠে পাশাপাশি সে বয়ান অনুসারে রাষ্ট্রের আচারণে রূপান্তর ঘটে। তারপর কনস্ট্রাক্টিভিস্ট তত্ত্বের গবেষকরা সেই দেশের দৃষ্টিভঙ্গি বা আচরণকে বিশ্লেষণ করে। অর্থাৎ, গবেষকগণ সেই ব্যাখ্যারও ব্যাখ্যা খুঁজে বের করেঃ কেন দেশটি এমন ভাবছে, এর পেছনে কী অর্থনীতি, সংস্কৃতি বা ইতিহাস কাজ করছে, না অন্যকিছু। এটাই হলো ডাবল হার্মেনিউটিক্স: মানুষের ব্যাখ্যা + গবেষকের ব্যাখ্যা = অর্থপূর্ণ বিশ্লেষণ।  

যেমন ধরুন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে "সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক" বলে ব্যাখ্যা করে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ব্যাখ্যা। তারপর গবেষকেরা আমেরিকার এই বয়ান বা দাবী বা ব্যাক্ষা পুনরায় মূল্যায়ন করে দেখতে চান। তি্নি বলেন যে, আমেরিকার এই বয়ানের মাধ্যমে আসলে যুক্তরাষ্ট্র তার জনগণকে ভয়ের মধ্যে রাখে, এই ব্যাখ্যা বা বয়ানের মাধ্যমে যুদ্ধকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে। আমেরিকার এমন বয়ানের উদাহরণ আরও অনেক আছে, যেমনঃ আফগানি্সতান, ইরাক, ভি্যেতনাম যুদ্ধ ইত্যাদি। এটা হল দ্বিতীয় ব্যাখ্যা। হয়তো গবেষকের এই ব্যাক্ষাকেও অন্য আরেক গবেষক বা রাষ্ট্র নতুন করে ব্যাক্ষা করতে পারে। এভাবে গবেষণা শুধু ঘটনা নয়, ঘটনার পেছনের ব্যাখ্যাগুলোও বিশ্লেষণ করে।   

এরূপ ব্যাক্ষা কেন গুরুত্বপূর্ণ? আসলে বিশ্ব রাজনীতিতে আমরা যা দেখি (যেমন যুদ্ধ, হুমকি, মিত্রতা), সব কিছুই মানুষের ব্যাখ্যার বা বয়ানের মাধ্যমে তৈরি। কনস্ট্রাক্টিভিজম তত্ত্ব অনুসারে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তাত্ত্বিক গবেষণা প্রধাণ উদ্দেশ্য হওয়া উচিত শুধু ঘটনাগুলো দেখাই নয়, বরং কেন সেগুলো ঘটছে তা বোঝা, এবং মানুষ বা রাষ্ট্র কীভাবে সে ব্যাক্ষা বা বয়ান তৈরি করছে, সেটি পুনঃব্যাখ্যা বা পুনঃবিশ্লেষণ করা।


উপসংহারঃ 

Constructivism আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (IR) শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। এই তত্ত্ব মতে, বিশ্ব রাজনীতি কেবল বস্তুগত (জাতীয়) স্বার্থ, শক্তি বা নিরাপত্তার ওপর দাঁড়িয়ে নয়; বরং ধারণা (ideas), পরিচয় (identity), সামাজিক নিয়ম (Social norms) এবং পারস্পরিক ব্যাখ্যার ওপর গড়ে ওঠে। এই তত্ত্ব intersubjectivity, কাঠামো ও কর্মক-এর পারস্পরিক গঠন এবং double hermeneutics (বয়ানের পুনঃমূল্যায়ন) এর মতো বিশ্লেষণী পদ্ধতি্র সাহায্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে সামাজিকভাবে নির্মিত (socially constructed) একটি প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করে। 

যদিও Constructivism এখনো neorealism-এর মতো একটি একক ও প্রভাবশালী তাত্ত্বিক কাঠামো হয়ে ওঠেনি, তবুও এর বহুমাত্রিকতা ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক চর্চায় নতুন চিন্তারক্ষেত্র তৈরি করতে সাহায্য করেছে। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে এই তত্ত্ব একটি নতুন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি (theoretical window) হিসেবে কাজ করেছে, যার মাধ্যমে গবেষকেরা সামাজিক বাস্তবতা, পরিচয় এবং বয়ান বা ব্যাক্ষার নির্মাণ প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃ্ত স্বরূপ সন্ধানের চেষ্টা করেছেন।

ফলে, Constructivism এখন আন্তর্জাতিক সমর্কের তাত্ত্বিক আলোচনার প্রান্তিক অবস্থানে নেই; বরং এটি বিশ্ব রাজনীতি বোঝার একটি শক্তিশালী ও প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠছে। 



অনুবাদক: 
বদিরুজ্জামান 
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 


মূল লেখক: 
Vincent Pouliot 
McGill University Montréal, Québec, Canada


মূল গ্রন্থ: 

International Encyclopedia of Political Science 






No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.